প্রকাশ :
২৪খবরবিডি: 'আজ ৯ই আগস্ট। জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে মৃত্যুর মাত্র ছয় দিন পূর্বে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।'
-জাতির পিতা গ্রামীণ উন্নয়ন এবং নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য দূর করার জন্য গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতায়নের বিষয়টিকে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করেন (অনুচ্ছেদ-১৬)। বঙ্গবন্ধুর এই বৈপ্লবিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তৎকালীন তৃতীয় বিশ্বে এটি একটি অনুসরণীয় মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-২৭ এর মাধ্যমে দেশের তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও উন্নয়নের লক্ষে বাংলাদেশ খনিজ, তেল ও গ্যাস কর্পোরেশন (বিএমওজিসি) গঠন করেন। ১৯৭৪ সালে এর সংক্ষিপ্ত নামকরণ করা হয় ‘পেট্রোবাংলা’। তিনি জ্বালানি খাতকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে পেট্রোলিয়াম আইন ও পেট্রোলিয়াম পলিসি প্রণয়ন করেন। উক্ত আইন ও পলিসির আওতায় তিনি দেশীয় কোনো মূলধন বা বিনিয়োগ ছাড়াই বিদেশী/বহুজাতিক কোম্পানির মাধ্যমে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনের লক্ষ্যে ‘উৎপাদন বণ্টন চুক্তি’ পদ্ধতি বাংলাদেশে প্রবর্তন করেন। বর্তমানে সারা বিশ্বে এই মডেলটি বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় হলেও ঐ সময়ে পৃথিবীর অনেক দেশই এই মডেলটির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেনি।
-বঙ্গবন্ধু তার দৃঢ় মনোবল, মেধা, সাহস ও সুকৌশলের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট বহুজাতিক কোম্পানি শেল ইন্টারন্যাশনালকে পাঁচটি বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র (তিতাস, বাখরাবাদ, রশিদপুর, কৈলাসটিলা ও হবিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র) মাত্র ১৭.৮৬ কোটি টাকায় বাংলাদেশের কাছে বিক্রয় করতে বাধ্য করেছিলেন, যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে ১২ লক্ষ কোটি টাকা। এটি কেবল আর্থিক মূল্য; এর অর্থনৈতিক মূল্য তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। স্বাধীন বাংলাদেশে গত চার দশকে যতটুকু শিল্পায়ন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে, তার মূল চালিকা শক্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর নামমাত্র মূল্যে কেনা গ্যাস ক্ষেত্রগুলো। মোটা দাগে বলতে গেলে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশে এ যাবত যা কিছু উন্নয়ন হয়েছে, তার সবটুকুই বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রদত্ত গ্যাস সম্পদের কারণে। আজ বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতসহ যে কয়েকটি খাতে আমরা বিশ্বে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছি, এর মূল কারণই ছিল জাতির পিতা দেয়া গ্যাস সম্পদ।
'পঁচাত্তরের পর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিরোধী শক্তি ক্ষমতাসীন হওয়ার কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তা অবহেলার শিকার হয়। ১৯৯৬-২০০১ সালে শেখ হাসিনার সরকারের সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে পরিস্থিতির উন্নতি হয়। পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় লুটপাটের ফলে আবারও জ্বালানি খাত মুখ থুবড়ে পড়ে। ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে দেশ আবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হচ্ছে।'
'অতীতের সরকারগুলোর জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতার ভ্রান্তনীতি পরিবর্তন করে শেখ হাসিনার সরকার জ্বালানির বহুমুখীকরণের (Diversification) নীতি গ্রহণ করেছে। এই ব্যবস্থায় দেশের জ্বালানি মিশ্রণে দেশীয় গ্যাস সম্পদের পাশাপাশি কয়লা, আমদানিকৃত এলএনজি, পারমানবিক বিদ্যুৎ, তরল জ্বালানি, আন্তঃরাষ্ট্রীয় জ্বালানি বাণিজ্যের মাধ্যমে আহরিত জ্বালানি/বিদ্যুৎ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে একটি টেকসই 'জ্বালানি ঝুড়ি' (Fuel Basket) গড়ে তোলা হচ্ছে। এটিই আন্তর্জাতিক বেষ্ট প্র্যাকটিস হিসেবে স্বীকৃত। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ যাতে কয়লাভিত্তিক বৃহত্তর বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করতে না পারে, সেজন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। এ সকল প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনার সরকার জাতীয় স্বার্থে বৃহৎ কয়লাভিত্তিক প্রকল্পসহ প্রয়োজনীয় সকল প্রকল্প বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। জ্বালানিভিত্তিক এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার মহেশখালী ও মাতারবাড়ীতে একটি এবং পায়রাতে একটি 'এনার্জি হাব' গড়ে তুলছে।
'ঐতিহাসিকভাবে জাতীয় ও আঞ্চলিক জ্বালানি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বাণিজ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি 'এনার্জি ডিপ্লোম্যাসি'কে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক ও দ্বি-পাক্ষিক পর্যায়ে প্রধান্য দিয়ে আসছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ভারত থেকে নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ আনার জন্যে ভেড়ামারায় যে ক্রসবর্ডার ইন্টারকানেকশন স্থাপিত হয়েছে, সেটি শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়া তথা উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এছাড়া ভারতের ত্রিপুরার সাথেও ক্রসবর্ডার ইন্টারকানেকশন স্থাপিত হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের মোট সরবরাহকৃত বিদ্যুতের ১০ শতাংশ ভারত থেকে আসছে যা দেশের উৎপাদিত বিদ্যুতের গড় মূল্যের তুলনায় অনেক সাশ্রয়ী। এছাড়া ভারতের ঝাড়খণ্ড ও ত্রিপুরা থেকে যথাক্রমে ১৪৯৬ ও ৩৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎসহ মোট ১৮৩৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভারতের সাথে বাংলাদেশের যে ক্রসবর্ডার ইন্টারকানেকশন স্থাপিত হয়েছে, বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই ইন্টারকানেকশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া ভুটার ও নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আনার কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের এই উদ্যোগে ভারত অংশীদার বা পার্টনার হিসেবে থাকছে। আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে জ্বালানিভিত্তিক সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরির লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার 'সার্ক ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট ফর এনার্জি কো-অপারেশন (ইলেকট্রিসিটি)'তে যুক্ত হয় এবং বিমসটেক এর সদস্য দেশগুলোর সাথে গ্রিড ইন্টারকানেকশন বিষয়ে সমঝোতা স্মারক চুক্তি স্বাক্ষর করে। শেখ হাসিনার এই উদ্যোগের ফলে ২০৪১ সাল নাগাদ আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ বাণিজ্য ও রিজিওনাল গ্রিড থেকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎ পাবে।'
-আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পৃথিবীর খুব কম দেশই এতো সফলভাবে সমুদ্রের উপর তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। শেখ হাসিনার এই সমুদ্র জয়ের ফলে 'দক্ষিণ এশিয়ার নর্থ সি' (North Sea of South Asia) খ্যাত বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস সম্পদ আহরণের মাধ্যমে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সরকার ইতোমধ্যে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রম কার্যকরী ও সুদক্ষভাবে পরিচালনা করছে। বর্তমানে ৭টি সমুদ্র ব্লকে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিসমূহ একক ও যৌথভাবে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। দেশে তেল-গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার গ্যাসের দৈনিক উৎপাদন ১৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট (২০০৮ সালে) হতে ২৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীতকরণসহ মোট গ্যাস সরবরাহ ৩২৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে (এলএনজিসহ) উন্নীত করেছে। এ সময়ে সরকার ৪টি নতুন গ্যাসক্ষেত্র (শ্রীকাইল, সুন্দরপুর, রূপগঞ্জ, ভোলা নর্থ) আবিষ্কার করেছে। তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার ২০১১ সালে 'গ্যাস উন্নয়ন তহবিল' গঠন করে, যার আওতায় দেশের গ্যাস সেক্টরে বর্তমানে ২১টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। এছাড়া গ্যাস সেক্টরকে সার্বিক সহায়তার জন্য ২০১৫ সালে সরকার 'এনার্জি সিকিউরিটি ফান্ড' নামে আরেকটি তহবিল গঠন করে।
-জাতির পিতা যে গ্যাস সম্পদ আমাদেরকে দিয়ে গেছেন, দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা তথা সার্বিক উন্নয়নের জন্য সেই সম্পদ রক্ষা করেছিলেন তারই কন্যা শেখ হাসিনা। এই তথ্য বঙ্গবন্ধুর কাছে অজানা ছিল না যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর ঠাণ্ডা লড়াইয়ের (Cold War) সময়ে বিশ্বব্যাপী কিছু জাতীয়তাবাদী নেতা নিজেদের দেশে বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রাকৃতিক ও জ্বালানি সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন, তাদের কেউ কেউ হত্যার শিকারও হয়েছিলেন। সেটি জানা সত্ত্বেও, তিনি ঔপনিবেশিক শক্তি ও বহুজাতিক কোম্পানিসমূহের অনুকূলে খনিজ ও জ্বালানি সম্পদের উপর প্রদত্ত ইজারাভিত্তিক মালিকানা জাতীয় স্বার্থে বাতিল করে সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদে এ সম্পর্কিত বিধান অন্তর্ভুক্ত করেন।
নিশ্চিত জ্বালানি নিরাপত্তা: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার অবদান
এই ধরণের বিধান সমকালীন সময়ে পৃথিবীর খুব কম দেশই তাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিল। জাতির পিতা প্রবর্তিত এই সাংবিধানিক বিধানের আলোকে পরবর্তীতে তিনিই নানামুখী আইনি, নীতিগত, নির্বাহী ও রেগুলেটরি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি আত্ম-নির্ভরশীল ও শক্তিশালী জ্বালানি খাত তৈরি করে গিয়েছিলেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল এদেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিয়ে মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন করা। এটিই ছিল বঙ্গবন্ধু সূচিত বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম মূল লক্ষ্য।
'জাতির পিতার পরে শেখ হাসিনাই একমাত্র রাষ্ট্রনায়ক যিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও বাধা উপেক্ষা করে জাতির পিতার এই লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নানামুখী কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে শুধু দুটি নাম দেদীপ্যমান- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আর রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা।'